PAGE AT A GLANCE (পৃষ্ঠা একনজরে) | |
1) আবির্ভাব ও বাল্যলীলা | 6) মানবী রূপে দেবী ও বিশ্বজননী |
2) শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে | 7) ঠাকুরের অসমাপ্ত কাজের দায়িত্বগ্রহণ |
3) দক্ষিণেশ্বরে আগমন | 8) আচার্য ও সঙ্ঘজননী |
4) এক আদর্শ জীবন | 9) সকলের মা, চিরকালের মা |
5) সংক্ষিপ্ত জীবনীপঞ্জী | 10) অমৃতবাণী |
শ্রীমা সারদাদেবী চিরকালীন মানুষের কাছে এক অপরূপ মাতৃত্বের ভালোবাসা ভরা আশ্রয়স্থল। ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর (১২৬০ সালের ৮ই পৌষ) বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী (Jayrambati) গ্রামে কৃষ্ণাসপ্তমীর রাতে তাঁর জন্ম। মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী ও পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রথম সন্তানের জন্মের আগে দেখেছিলেন লাল কাপড় পরা অতিসুন্দরী এক কন্যা তাদের কাছে আসছেন। দরিদ্র, সরল, ভক্ত দম্পতি আভাস পেয়েছিলেন কোন দেবীর আগমন হতে চলেছে।
শিহড়ে কীর্তনের আসরে দু’বছরের ছোট্ট মেয়েকে এক প্রতিবেশী পল্লীরমণী সাদরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই যে এত লোক রয়েছে, এদের মধ্যে কাকে তোর বিয়ে করতে সাধ যায়?’ দু’খানি কচি হাত উঠিয়ে সারদা গদাধরের দিকে নির্দেশ করেছিল। পরবর্তী সময়ে গদাধরের বিবাহের জন্য মাতা ও অগ্রজ যখন পাত্রীর সন্ধান পাচ্ছেন না, ভাবাবেশে গদাধরই জয়রামবাটীর রামচন্দ্র মুখুজ্যের বাড়িতে বিয়ের কনে কুটোবাধা থাকার সন্ধান দিয়েছিলেন। ১৮৫৯-এর বৈশাখ মাসে সদ্য ছয় বছরে পা রাখা সারদামণির সঙ্গে চব্বিশ বছরের যুবক গদাধরের বিবাহ যেন দৈবনির্দিষ্ট এক নতুন ইতিহাসের সূচনা। খুল্লতাতের কোলে চেপে বালিকাবধু এসেছিল কামারপুকুরের (Kamarpukur) শ্বশুরালয়ে। খেজুরগাছের তলায় পাকা খেজুর পরে থাকতে দেখে সে মহানন্দে তা কুড়োতে লেগেছিল। লাহাবাবুদের বাড়ি থেকে ধার করে আনা গহনায় তাকে সজ্জিত করা হয়েছিল। পরে গহনাগুলি লাহাবাবুদের ফেরত দেওয়ার সময় মাতা চন্দ্রমণি ভেবেই আকুল কোমলমতি বালিকার সোনার অঙ্গ থেকে ঐ গহনা কেমন করে খুলে নেবেন। শেষে মা-এর সমস্যা বুঝতে পেরে গদাধর নিজেই সারদা ঘুমিয়ে পড়লে গহনাগুলি খুলে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ঘুম ভেঙ্গে গহনাগুলি নেই দেখে ছোট্ট সারদা কেঁদে সারা। পরে ভাল অলঙ্কার পাবে বলে চন্দ্রমণি নববধূকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন।
বিবাহের পর সারদা ফিরে এসেছিলো পিতৃগৃহে। জয়রামবাটীর গ্রামীণ পরিবেশে পল্লীপ্রকৃতির কোলে সারদা বড় হতে থাকে। ধান-ভাঙ্গা, পৈতে তৈরী, গরুর জাবনা দেওয়া, রান্নাবান্না- সংসারে মায়ের নানা কাজে ছোট্ট দুই হাতে সাধ্যমতো সাহায্য করে সে। গলা সমান জলে নেমে গরুর জন্য দলঘাস কেটে আনে। মুনিষদের জন্য মুড়ি নিয়ে যায় ক্ষেতে। ছোট্ট ভাইবোনেদের আমোদর নদীতে স্নান করতে নিয়ে যায়। পঙ্গপালে কাটা ধান কুড়িয়ে আনে ক্ষেত থেকে। ১৮৬০-এর শেষ দিকে (১২৬৭-র অগ্রহায়ণ) গদাধর জয়রামবাটী এসেছিলেন। সাত বছরের বালিকা সারদামণিকে কেউ শিখিয়ে না দিলেও শ্রীরামকৃষ্ণের চরণযুগল ধুয়ে দিয়ে তাকে বাতাস করেছিল। কয়েকদিন জয়রামবাটীতে থাকার পর গদাধর বধূসহ ফিরে এসেছিলেন কামারপুকুরে। কামারপুকুরে কিছুদিন থেকে গদাধর ফিরে এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে, সারদামণিও ফিরে গিয়েছিলেন পিতৃগৃহে। ১৮৬৪-৬৫ -র করাল দুর্ভিক্ষের সময় রামচন্দ্র তার মরাই-এ জমানো ধান থেকে অন্নসত্র খুলেছিলেন। গরম খিচুড়ি ক্ষুধার্ত মানুষের পাতে ঢালা হলে সারদা পাখার বাতাস করে সেই খিচুড়ি ঠান্ডা করে দিত। ১৮৬৬-র মে মাসে সারদামণি তৃতীয় বার শ্বশুরালয়ে এসেছিলেন। গদাধর তখন দক্ষিণেশ্বরে সাধনারত। মাতা চন্দ্রমণি দেবীও তখন দক্ষিণেশ্বরে ছিলেন, যদিও কামারপুকুরে গদাধরের অন্যান্য আত্মীয়রা ছিলেন। হালদারপুকুরে একাকী স্নানে যাওয়ার সময় সারদার মনে ভীতির উদ্রেক হওয়ায় দেখেছিলেন, আটটি দিব্যকন্যা (অষ্টসখী) উপস্থিত হয়ে তাঁর সম্মুখে ও পিছনে চারজন করে বেষ্টিত করে হালদার পুকুরে নিয়ে যাচ্ছে ও প্রত্যাবর্তন করছে। ১৮৬৬-র ডিসেম্বরে চতুর্থবার শ্বশুরালয়ে এসে তিনি প্রায় দেড় মাস কামারপুকুরে অবস্থান করেছিলেন। কামারপুকুরে থাকাকালীন ঠাকুরের ভাইঝি লক্ষীদিদি ও তিনি একটু একটু বর্ণ পরিচয় পড়তে শুরু করেছিলেন। লক্ষীদিদি পাঠশালায় গিয়ে পড়ে এসে তাঁকে পড়াতেন।
১৮৬৭-র মে মাসে শ্রীরামকৃষ্ণ কামারপুকুরে এসেছিলেন তাঁর তন্ত্র সাধনার গুরু ভৈরবী ব্রাহ্মণীর সঙ্গে। সারদাকেও তখন শ্বশুরালয়ে আহ্বান করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সংসারে অনভিজ্ঞা সরলা কিশোরীকে নানা বিষয়ে তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন। একদিকে যেমন নিজের ত্যাগোজ্জ্বল জীবনাদর্শ তুলে ধরে শ্রীরামকৃষ্ণ উচ্চ ধর্মজীবন লাভের জন্য কিভাবে চরিত্র গঠন করতে হয় তা শিক্ষা দিয়েছিলেন, অপরদিকে তেমনি দৈনন্দিন গৃহস্থালিকর্ম, দেব-দ্বিজ-অতিথি সেবা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, কনিষ্ঠদের প্রতি স্নেহপরায়ণতা, পরিবারের সেবায় আত্মসমর্পণ ইত্যাদি বহু বিষয়ে তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন – এই নীতিকে ভিত্তি করে লোকব্যবহার, পরিবারের প্রত্যেকের রুচি, স্বভাব ও প্রয়োজন অনুযায়ী তার সঙ্গে আদান প্রদান, নৌকায় বা গাড়ীতে যাওয়ার সময় দ্রব্যাদি সম্বন্ধে সতর্কতা, এমনকি প্রদীপের পলতেটিও কেমন করে রাখতে হয় ইত্যাদি কিছুই সে অপূর্ব শিক্ষা থেকে বাদ পড়ল না। এক নাগাড়ে সাত মাস সদানন্দময় শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থেকে সদ্য কিশোরী সারদার ব্যক্তিত্ব অভিনব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। হৃদয়ের মধ্যে যেন এক আনন্দের পূর্ণঘট স্থাপিত আছে বলে অনুভব করেছিলেন তিনি। সেই ধীর-স্থির দিব্য উল্লাসে তার অন্তর অবর্ণনীয় পূর্ণতায় ভরে গিয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ফিরে গেলে সারদামণিও ফিরে এসেছিলেন জয়রামবাটীতে। পল্লীগ্রামের শান্ত পরিবেশে পিতৃগৃহে এভাবে কেটে গিয়েছিল প্রায় চার বছর। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্য সাধনার সংবাদ লোকমুখে কিছুটা বিকৃত হয়ে জয়রামবাটিতে গ্রাম্য জল্পনার খোরাক জুগিয়ে তুলেছিল। গ্রামবাসীরা মনে করেছিল, সারদার স্বামী উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। প্রতিবেশীরা অনেকেই তাঁকে দেখে সরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, আহা পাগলের স্ত্রী। কেউবা শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিলেন শ্যামার মেয়ের ক্ষাপা জামাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। পতিনিন্দা অসহ্য লাগলে অনেক সময়ে তিনি ভক্তিমতি সহৃদয়া ভানু পিসির বাড়ীর বারান্দায় আঁচল বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন ও তাঁর কাছে কিছুটা সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, সবাই যখন এমন বলছে, একবার নিজেই দক্ষিণেশ্বরে (Dakshineswar) গিয়ে দেখে আসবেন সেই আনন্দময় পুরুষটি কেমন আছেন। দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে গঙ্গাস্নানে যাচ্ছিলেন গ্রামের অনেক পুণ্যার্থী মানুষ। মেয়ের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে ১৮৭২-এ মার্চে পিতা রামচন্দ্র মেয়েকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন তাদেরই সাথে। অনভ্যস্ত শরীরে পথশ্রমে সারদা জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়লে, পথের ধারে চটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন রামচন্দ্র। রাতে স্বপ্নে সারদা দেখেছিলেন পরমাসুন্দরী কৃষ্ণবর্ণা এক নারী তাঁর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, সেবা যত্ন ও আশ্বাসে তাঁকে সুস্থ করে তুলছে। পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল সে তাঁর বোন হয়, থাকে দক্ষিণেশ্বরে। পরদিন সারদা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ও দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সস্নেহে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর চিকিৎসার সুব্যবস্থা করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্নের উত্তরে সারদা বলেছিলেন, তাঁকে সংসারের পথে টেনে নিতে তিনি আসেননি, এসেছেন তাঁর ঈষ্ট পথেই সাহায্য করতে। আবার সারদামণির ‘আমাকে তোমার কি বলে মনে হয়’ এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ জানিয়েছিলেন ‘যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এ শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও এখন নহবতে বাস করছেন, আর তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ বলে তোমায় সর্বদা সত্য সত্য দেখতে পাই।’ কামগন্ধহীন ও মানবীয় দেহসম্বন্ধবিহীন এই অপার্থিব দাম্পত্য আধ্যাত্মিকতার উত্তুঙ্গ শিখরে আরোহণ করেছিল।
১৮৭২-এ জুন মাসে ফলহারিণী কালীপুজোর দিন শ্রীরামকৃষ্ণ আপন পত্নী সারদামণিকে ষোড়শী বা ত্রিপুরাসুন্দরীরূপে পুজো করেছিলেন ও শ্রীচরণে সাধনার ফল, জপের মালা সমর্পণ করেছিলেন। মঙ্গলকলস থেকে গঙ্গাবারি নিয়ে দেবীকে অভিষেক করে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘ হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী! সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করো। ইহার (সারদাদেবীর) শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূত হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর।’ যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা ও তাঁর সাধনালব্ধ ফল গ্রহণ করে সারদামণির মানবী শরীরে জগৎকল্যাণকারিণী মহাশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন যুগাবতারের মহান কর্মের ভার গ্রহণ করার জন্য। তাঁর মধ্যে আজন্মলালিত বিশ্বমাতৃত্বের বীজ ক্রমবিকাশের মুহূর্তে তিনি হয়ে উঠছিলেন সকলের মা, ‘গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়-সত্য জননী’।
দক্ষিণেশ্বরে নহবতের একতলার ছোট, আটকোণা, স্বল্প উচ্চতার ঘরে শ্রীমায়ের আবাসস্থল ছিল। ঘরটিতে ঢুকতে গিয়ে মাথা ঠুকে গিয়ে একদিন শ্রীমায়ের মাথায় কেটে গিয়েছিল। অপরিসর ঘরটিতে রান্না, থাকা, খাওয়া সবরকম কাজই শ্রীমাকে করতে হত। ঘরটিতে জিনিসপত্র রাখার জন্য উপরে সব শিকে ঝোলানো ছিল। লোকচক্ষুর অন্তরালে নিভৃত রাতে (রাত তিনটের সময়) ঘুম থেকে উঠে শৌচ ও স্নানাদি সেরে গভীর সাধনায় মগ্ন হয়ে থাকতেন। চাঁদের দিকে তাকিয়ে জানিয়েছিলেন এক অশ্রুতপূর্ব প্রার্থনা – ‘চাঁদেও কলঙ্ক আছে – আমার মনে যেন কোন দাগ না থাকে।’ পূজা, জপ, ধ্যান এতে প্রায় দেড়ঘন্টা কেটে যেত। তারপর দোতলার সিঁড়ির নীচে রান্না করতে বসতেন। ঠাকুরের জন্য রান্নার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের আগমন সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাৎ সেই ভক্তদের জন্যও বিশেষ ধরণের রান্না করতে হত শ্রীমাকে। নরেন বা রাম দত্তের জন্য ছোলার ডাল আর ময়দার রুটি, রাখালের জন্য খিঁচুড়ি রান্না হত। শ্রীরামকৃষ্ণ, তাঁর মাতা চন্দ্রমণিদেবীর সেবা ও পরবর্তীকালে ঠাকুরের কাছে আসা শিষ্য ও ভক্তদের জন্য বিভিন্ন আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি গভীর সাধনা জপ ধ্যান – আধ্মাতিক চর্চার মধ্য দিয়ে এক আদর্শ জীবনের দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। লক্ষীদিদির সঙ্গে মায়ের ভজন সঙ্গীত শুনতে পেয়ে ঠাকুর তার প্রশংসা করেছিলেন। মাকালীর জন্য জুঁই আর রঙ্গনের এমন অপুর্ব মালা গেঁথে ছিলেন, যা দেখে শ্রীরামকৃষ্ণও মুগ্ধ হয়েছিলেন। মহিলা ভক্তরা অনেকসময় ঐ ঘরে মায়ের সঙ্গে রাত্রে থেকেও যেতেন। তাঁদের কেউ ছোট ঘরটির দরজার দুদিকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতো, ‘আহা! কি ঘরেই আমাদের সতীলক্ষী আছেন গো – যেন বনবাস গো।’ দিনের বেলায় শৌচে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও যেতে পারতেন না, রাত্রে যেতে হত। বেগ ধারণ করে শেষে পেটের রোগ ধরে গিয়েছিল। ষোড়শী পুজোর প্রায় এক বছর পরে শ্রীমা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। শ্রীযুক্ত শম্ভুনাথ মল্লিক ডাক্তার প্রসাদবাবুকে ডেকে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়ায় তিনি জয়রামবাটীতে ফিরে এসেছিলেন। জয়রামবাটিতে ১৮৭৪-এর ২৬শে মার্চ পিতা রামচন্দ্রের দেহাবসান হয়। পিতৃস্নেহে লালিতা প্রথমা কন্যার বুকে এ বিচ্ছেদ চরম আঘাত করেছিল। পুনর্বার রোগাক্রান্ত হয়ে শ্রীমা গ্রামের দেবী সিংহবাহিনীর কাছে হত্যা দিয়েছিলেন ও দৈবী ওষুধ গ্রহণে সুস্থ হয়েছিলেন। শারীরিক ব্যাধি ও পারিবারিক শোক থেকে মুক্তি পাওয়ার আগেই তিনি পুনর্বার ম্যালেরিয়ার কবলে পড়েছিলেন। কয়াপাট-বদনগঞ্জে গিয়ে প্লীহা নিয়ন্ত্রণে আনার গ্রাম্য চিকিৎসা (জ্বলন্ত কুলকাঠ দিয়ে পেটের উপর কিছুটা জায়গা ঘষে দেওয়া হত) শ্রীমা অবিচলিত ভাবে নীরবে গ্রহণ করেছিলেন। ইতিমধ্যে ১৮৭৬-এর ২৭শে ফেব্রুয়ারী ঠাকুরের জন্মতিথি দিবসে তাঁর জননী শ্রীযুক্ত চন্দ্রমণি দেবী দেহত্যাগ করেছিলেন। ঠাকুরের মাতা ঠাকুরাণীর দেহত্যাগের সংবাদ পেয়ে অসুখ সারবার অল্প পরে (১৭ই মার্চ, ১৮৭৬) শ্রীমা দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
অন্তর্যামী, পূতচরিত্র শ্রীরামকৃষ্ণ সকলের হাতের খাবার খেতে পারতেন না। ঠাকুরের ভাতের থালা কোন এক মহিলার অনুরোধে তার হাতে তুলে দেওয়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ যখন ঐ স্পর্শ দুষ্ট অন্ন খেতে পারবেন না বলে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, তখন মা বলেছিলেন ‘তোমার খাবার আমি নিজেই নিয়ে আসব কিন্তু আমায় মা বলে চাইলে আমি তো থাকতে পারবো না। আর তুমি তো শুধু আমার ঠাকুর নও – তুমি সকলের।’ মুকুলিত মাতৃভাবের অপার ফল্গুধারা এভাবেই বারে বারে ঝরে পড়েছে আগত অবোধ সন্তানদের উপরে। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর দৈবী দাম্পত্যসম্পর্কটি ছিল বড় মধুর তারে বাধা। ভাইঝি লক্ষিমণি ভেবে একবার তাঁকে ‘তুই’ বলে ফেলায় শ্রীরামকৃষ্ণ সারারাত ভালো করে ঘুমোতে পারেন নি। পরদিন সকালে নহবতে গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন ‘কিছু মনে কোরো না’ বলে। পঞ্চবটীতে সীতামায়ের দর্শন কালে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর হাতে যেমন ডায়মন্ড কাট সোনার বালা দেখেছিলেন, অনুরূপ সোনার অলঙ্কার মায়ের জন্য গড়িয়ে দিয়েছিলেন। কোন ঘটনায় শ্রীমা ক্ষুণ্ণ হলে ঠাকুর বিচলিত হতেন। ভাগ্নে ও সেবক হৃদয়কে তিনি মায়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন ‘এর ভিতরে যে আছে সে ফোঁস করলে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরও তোকে রক্ষা করতে পারবে না’।
লছমী নারায়ণ মাড়ওয়ারী একবার দশ হাজার টাকা ঠাকুরকে দান করতে চাইলে ঠাকুর শ্রীমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ঐ টাকা তাঁর নামে নেওয়া হবে কি না। অনমনীয় কণ্ঠে শ্রীমা ঐ দান প্রত্যাখান করে বলেছিলেন যে ‘আমি নিলে ও টাকা তোমারই নেওয়া হবে। তোমাকে লোকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে ত্যাগের জন্য। কাজেই টাকা কিছুতেই নেওয়া হবে না’। আবার কালীমন্দির থেকে ভাবোন্মত্ত অবস্থায় টলতে টলতে ঘরে এসে অকস্মাৎ মাকে একটু ঠেলে ঠাকুর প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ওগো আমি কী মদ খেয়েছি?’ মা তখন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলেছিলেন, ‘না। মদ কেন খাবে? তুমি মা কালীর ভাবামৃত খেয়েছ।’ এমনি নানা টুকরো ঘটনায় শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীমায়ের সমপ্রাণতা ও আধ্মাতিক সহাবস্থানের স্তরটি প্রকাশ পেয়েছে।
দীর্ঘ তেরো চোদ্দ বছর তিনি কামারপুকুর বা জয়রামবাটী থেকে দক্ষিণেশ্বর আসা যাওয়া করেছিলেন। একবার শ্রীমা লক্ষীদিদি, শিবুদা ও কিছু গ্রামবাসীর সঙ্গে আসছিলেন কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বরের উদ্দেশ্যে। আরামবাগে পৌঁছানোর পর শ্রীমায়ের সঙ্গীরা খুনে ডাকাত অধ্যুষিত, কুখ্যাত তেলেভেলোর মাঠ সেইদিনই পেরিয়ে তারকেশ্বরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শ্রান্ত দেহ ও কোমল পদদ্বয়ে শ্রীমা তাদের অনুগমন করলেও অক্ষমতাবশত ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিলেন। সঙ্গীরা বুঝেছিল যে এত মন্থর গতিতে চললে সন্ধে নামার আগে ঐ কুখ্যাত প্রান্তর পার হওয়া সম্ভব হবে না। আর শ্রীমাও তাঁর জন্য কোন দুশ্চিন্তা না করে তাদের দ্রুত তারকেশ্বরে চলে যেতে বলেছিলেন। সন্ধে নামার ঠিক আগে একাকীনি শ্রীমায়ের পথ রোধ করে দাড়িয়েছিল এক ডাকাত। তার কর্কশ স্বরে পরিচয় ও গন্তব্য জিজ্ঞাসায় ভীত হননি শ্রীমা। নিজেকে মেয়ে বলে পরিচয় দিয়ে দক্ষিণেশ্বরে তার জামাইয়ের কাছে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। শ্রীমায়ের নিঃসঙ্কোচ সরল, মিষ্টি ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ডাকাতটিও তাঁকে অভয় দিয়ে নিজের স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ডাকাত দম্পতি সত্যিই কন্যাসম আদরের সঙ্গে শ্রীমাকে মুড়ি-মুরকি খাইয়ে রাতে নিরাপদে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ও পরদিন সকালে ক্ষেতের কড়াইশুটি খাওয়াতে খাওয়াতে তারকেশ্বরে পৌঁছে দিয়েছিল। সেখানে শ্রীমায়ের সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে বিদায়কালে ডাকাতদম্পতি ও শ্রীমা, উভয়ের চোখেই জল। অবশেষে, দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই ডাকাত দম্পতি বিদায় নিয়েছিল। ডাকাত দম্পতি মাঝে মধ্যে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীমার খোঁজ খবর নিতে আসত। পরবর্তীতে শ্রীমাকে তারা বলেছিল যে শ্রীমায়ের মধ্যে তারা দেখেছিল মা কালীকে।
ঠাকুরের অসমাপ্ত কাজের দায়িত্বগ্রহণ
ঠাকুরের গলার ক্যানসার রোগের সূত্রপাত হওয়ার পর (১৮৮৫) চিকিৎসার সুবিধার জন্য দক্ষিণেশ্বর থেকে প্রথমে তাঁকে কলকাতায় শ্যামপুকুরে ও পরে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আনা হয়েছিল। সেখানেও শ্রীমা ঠাকুরের পথ্য তৈরী ও তাঁর সেবা করতেন। ঠাকুরের সেবার জন্য সমস্ত বাহ্যিক অসুবিধাই তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন। শ্যামপুকুরে অন্যান্য ভক্তরা শয্যাত্যাগের আগেই শ্রীমা স্নানাদি সেরে তিনতলার ছাদের সিড়ির পাশে একটি চাতালে চলে আসতেন। ঠাকুরের পথ্য রান্না করে ওখানেই সময় কাটাতেন। আবার সকলে ঘুমিয়ে পরলে আন্দাজ রাত এগারটার সময় ঘরে এসে একটু বিশ্রাম করতে যেতেন। পরে ঠাকুরকে কাশীপুরের উদ্যানবাটীতে (Cossipore Udyanbati) আনা হলে শ্রীমা সেখানেও তাঁর সেবার ভার গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে মহাসমাধির পূর্বে নিজের অসমাপ্ত কাজের কথা মনে রেখে ঠাকুর শ্রীমাকে বলেছিলেন,‘হ্যাঁ গা, তুমি কি কিছু করবে না? (নিজের শরীর দেখিয়ে) এই সব করবে?’ শ্রীমা বলেছিলেন,‘ আমি মেয়ে মানুষ। আমি কি করতে পারি? ’। এর উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন,‘ না, না। তোমায় অনেক কিছু করতে হবে।’ অন্য একদিন বলেছিলেন, ‘দেখো, কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিলবিল করছে। ওদের তুমি দেখো।’ ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট কাশীপুরের বাগানবাড়িতে ঠাকুরের লীলা সংবরণের পরদিন সন্ধ্যায় শ্রীমা যখন একে একে অলঙ্কার উন্মোচন করে সোনার বালাও খুলতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন ঠাকুর পূর্বমূর্তিতে আবির্ভুত হয়ে তাঁর হাত চেপে ধরে বলেছিলেন,‘ আমি কি মরেছি যে, তুমি এয়োস্ত্রীর জিনিস হাত থেকে খুলে ফেলেছো?’
কাশীপুর উদ্যানবাটী ছেড়ে দেওয়া হলে ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর গৃহে আটদিন থাকার পরে ভক্তেরা শ্রীমায়ের তীর্থযাত্রার আয়োজন করেছিলেন। লক্ষীদিদি, গোপাল মা, যোগীন মহারাজ, কালী মহারাজ ও লাটু মহারাজদের সঙ্গে নিয়ে শ্রীমা প্রথমে বৈদ্যনাথ ধাম পরে কাশী ও অযোধ্যা হয়ে বৃন্দাবন দর্শন করেছিলেন। বৃন্দাবনে এসে বিরহবিধুরা শ্রীমায়ের মনে ক্রন্দনের হাহাকার উঠেছিল। বৃন্দাবনে যোগীন মার সঙ্গে সাক্ষাতের পর উভয়েই যখন ক্রন্দনরতা, ঠাকুর এক রাতে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ গা, তোমরা এত কাঁদছ কেন? এই তো আমি রয়েছি, গেছি কোথায়? এই যেমন এঘর আর ওঘর’। ঘন ঘন ঠাকুরের দর্শনলাভে বিরহবিদগ্ধা শ্রীমার মন একদিকে যেমন অনেকটা শান্ত হয়েছিল, তেমনি তাঁর সবখানি সত্ত্বা নিরন্তর শ্রীরামকৃষ্ণধ্যানে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকতো। এক অপরিসীম বৈরাগ্যে অন্তর্লীন অনুধ্যানে তাঁর তীর্থবাসের এক বৎসর কাল কেটে গিয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে বৃন্দাবনে স্বামী যোগানন্দকে মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে তাঁর আচার্য্য জীবনের আনু্ষ্ঠানিক সূচনাটিও ঘটেছিল। তীর্থযাত্রার পরে কলকাতায় বলরাম বসুর বাড়িতে ফিরে তিনি কামারপুকুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন কারোর কাছে দান না চেয়ে কামারপুকুরের নিজের ভিটেতে শাক বুনে হরিনাম করতে করতে দিন কাটাতে। কামারপুকুরে চরম দারিদ্রের মধ্যে কঠোর কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশটি পালন করেছিলেন। পরে সন্ন্যাসী সন্তান ও অন্যান্য ভক্তরা শ্রীমার দারিদ্র্যের কথা জানতে পেরে তাঁকে কখনও ঘুসুড়ীতে, কখনও বেলুড়ে বা কখনও বাগবাজারের ভাড়াবাড়িতে রেখে তাঁর সেবা করেছিলেন। মাঝে মাঝে জয়রামবাটিতে মা ভাইদের সঙ্গেও যখন ছিলেন, সেখানেও কায়িক পরিশ্রমের অন্ত ছিল না। পরবর্তী সময়ে শ্রীমা জগন্নাথধাম ও বুদ্ধগয়া দর্শন করেছিলেন। বুদ্ধগয়ায় বৌদ্ধসঙ্ঘ দর্শন করার পর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সন্ন্যাসী সন্তানদের মাথা গোঁজার ঠাইয়ের বন্দোবস্ত করার জন্য ব্যাকুল প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। ১৮৯৩-এর ১২ নভেম্বর যখন স্বামীজী বেলুড়ে মঠ (Belur Math) স্থাপন করেছিলেন, নতুন মঠভূমিতে পদার্পণ করে শ্রীমা স্বয়ং ঠাকুরের পুজো করেছিলেন। পরদিনই সকালে (১৩ নভেম্বর) শ্রীমা স্বামীজি, ব্রহ্মানন্দজী ও সারদানন্দজীর উপস্থিতিতে বাগবাজারে নিবেদিতার বিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের সূচনা ও নিবেদিতার বিদ্যালয়ের উপলক্ষে নারীশিক্ষা ও ভাবী স্ত্রীমঠের সূত্রপাত হয়েছিল শ্রীমায়ের হাত দিয়ে। স্বামীজি ১৮৯৭ সালের ১লা মে রামকৃষ্ণ মিশন (Ramakrishna Mission) প্রতিষ্ঠা করে শ্রীমাকেই সঙ্ঘের নেত্রী, সঙ্ঘজননী রূপে ঘোষণা করেছিলেন। যে কোন সংশয় সমস্যায় শ্রীমায়ের আদেশকেই ‘ হাইকোর্টের রায়’ বলে সঙ্ঘের কর্ণধারগণ মাথা পেতে মেনে নিতেন।
সন্ন্যাসী ও গৃহী, পুণ্যবান-পাপী, ধনী-দরিদ্র, অভিজাত-অনভিজাত সকলের জন্যই ছিল তাঁর দ্বার উন্মুক্ত। মা বলে যে কেউ এসে দাঁড়ালে অহেতুক কৃপাবর্ষণে স্নিগ্ধস্নাত করেছিলেন তাঁদের। স্বামীজি, তাঁর পাশ্চাত্য ভক্ত জোসেফিন ম্যাকলাউড, সারা বুল, নিবেদিতাকে নিয়ে শ্রীমায়ের কাছে আসলে শ্রীমা তাঁদের সাদরে কন্যা বলে গ্রহণ করেছিলেন ও প্রচলিত রক্ষণশীলতারূপ প্রতিবন্ধকতার বাধা সরিয়ে তাঁদের সঙ্গে আহার করেছিলেন। স্বামী সারদানন্দ মহারাজ ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে উদ্বোধনে মায়ের বাড়ি (Udbodhon, Mayer Bari) তৈরী সম্পূর্ণ করে শ্রীমাকে সেখানে নিয়ে এসেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দর্শন দিয়ে ভাইজি রাধুকে যোগমায়া জ্ঞানে আশ্রয় করে সংসারে থাকতে বলেছিলেন। লীলা অবসানের কাল যতই আসন্ন হল, দেখা গেল শ্রীমায়ের মন ক্রমশ রাধুর থেকে উঠে গেল। লীলা সংবরণের কিছু দিন পূর্বে ভক্ত অন্নপূর্ণার মা শ্রীমাকে প্রণাম করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,‘ মা, আমাদের কী হবে?’ শ্রীমা বলেছিলেন,‘ যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগতকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয় মা, জগত তোমার।’ অনাগত কালের উদ্দেশ্যে এই বাণী যেন তাঁর সকল সন্তানদের জন্য শান্তিতে জীবনযাপনের সারশিক্ষা। ১৯২০ সালের ২১শে জুলাই রাত দেড়টার সময় শ্রীমা মহাসমাধিতে লীন হলেন। বেলুড়ে গঙ্গার তীরে তাঁর দেহ চিতাগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়েছিল। ১৯২১–এ সেই পবিত্রস্থানে মাতৃমন্দির নির্মিত হয়। দেশবিদেশের বহু মানুষ আজও জীবনের যে কোন সমস্যায় মাতৃস্মরণে প্রণত হয় পথনির্দেশের আশায়। বুঝতে পারে আর কেউ না থাক, তাদের একজন মা আছেন।
১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর (১২৬০ সালের ৮ই পৌষ) বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে কৃষ্ণাসপ্তমীর রাতে জন্ম।
১৮৫৯- বৈশাখ মাসে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সারদামণির বিবাহ ।
১৮৬০-এর শেষ দিকে (১২৬৭-র অগ্রহায়ণ) গদাধর জয়রামবাটী এসেছিলেন। সাত বছরের বালিকা সারদামণি কেউ শিখিয়ে না দিলেও শ্রীরামকৃষ্ণের চরণযুগল ধুয়ে দিয়ে তাকে বাতাস করেছিল।
১৮৬৪-৬৫ দুর্ভিক্ষের সময় পিতা রামচন্দ্র অন্নসত্র খুলেছিলেন। গরম খিচুড়ি ক্ষুধার্ত মানুষের পাতে ঢালা হলে সারদা পাখার বাতাস করে সেই খিচুড়ি ঠান্ডা করে দিত।
১৮৬৬-র মে মাসে সারদামণি তৃতীয় বার শ্বশুরালয়ে এসেছিলেন। হালদারপুকুরে একাকী স্নানে যাওয়ার সময় ভীতির উদ্রেক হওয়ায় দেখেছিলেন, আটটি দিব্যকন্যা (অষ্টসখী) উপস্থিত হয়ে তাঁর সম্মুখে ও পিছনে চারজন করে বেষ্টিত করে হালদার পুকুরে নিয়ে যাচ্ছে ও প্রত্যাবর্তন করছে।
১৮৬৬-র ডিসেম্বরে চতুর্থবার শ্বশুরালয়ে এসে তিনি প্রায় দেড় মাস কামারপুকুরে অবস্থান করেছিলেন। কামারপুকুরে থাকাকালীন ঠাকুরের ভাইঝি লক্ষীদিদি ও তিনি একটু একটু বর্ণ পরিচয় পড়তে শুরু করেছিলেন।
১৮৬৭-র মে মাসে শ্রীরামকৃষ্ণ কামারপুকুরে এসে সারদাকেও শ্বশুরালয়ে আহ্বান করেছিলেন ও সংসারে অনভিজ্ঞা সরলা কিশোরীকে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন।
১৮৭২-এর মার্চে পিতা রামচন্দ্রের সঙ্গে প্রথম দক্ষিণেশ্বরে আগমন।
১৮৭২-এ জুন মাসে ফলহারিণী কালীপুজোর দিন শ্রীরামকৃষ্ণ আপন পত্নী সারদামণিকে ষোড়শী বা ত্রিপুরাসুন্দরীরূপে পুজো করেছিলেন ও শ্রীচরণে সাধনার ফল, জপের মালা সমর্পণ করেছিলেন।
১৮৭৪-এর ২৬শে মার্চ পিতা রামচন্দ্রের দেহাবসান হয়। পুনর্বার রোগাক্রান্ত হয়ে শ্রীমা গ্রামের দেবী সিংহবাহিনীর কাছে হত্যা দিয়েছিলেন ও দৈবী ওষুধ গ্রহণে সুস্থ হয়েছিলেন।
১৮৮৬-র ১৬ই আগষ্ট (৩১শে শ্রাবণ, ১২৯৩) রাত্রি ১টা ২ মিনিটে – ঠাকুরের মহাসমাধি। ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর গৃহে আটদিন থাকার পরে শ্রীমায়ের তীর্থযাত্রা -প্রথমে বৈদ্যনাথ ধাম পরে কাশী ও অযোধ্যা হয়ে বৃন্দাবন।
১৮৯৩-এর ১২ নভেম্বর স্বামীজী বেলুড়ে মঠ (Belur Math) স্থাপন করেছিলেন, নতুন মঠভূমিতে পদার্পণ করে শ্রীমা স্বয়ং ঠাকুরের পুজো করেছিলেন। পরদিনই সকালে (১৩ নভেম্বর) শ্রীমা স্বামীজি, ব্রহ্মানন্দজী ও সারদানন্দজীর উপস্থিতিতে বাগবাজারে নিবেদিতার বিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন।
১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী সারদানন্দ মহারাজ উদ্বোধনে মায়ের বাড়ি (Udbodhon, Mayer Bari) তৈরী সম্পূর্ণ করে শ্রীমাকে সেখানে নিয়ে এসেছিলেন।
১৯২০ সালের ২১শে জুলাই রাত দেড়টার সময় মহাসমাধি।
অভ্যাস
যেমন ফুল নাড়তে -চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবৎ-তত্ত্বের আলোচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়।
দৈনন্দিন জীবনচর্যা
যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যখন যেমন তখন তেমন।
সৎসঙ্গে মেশো, ভাল হতে চেষ্টা কর, ক্রমে সব হবে।
কাজ করা চাই বই কি, কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়, তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়।
মনটাকে বসিয়ে আলগা না দিয়ে কাজ করা ঢের ভাল। মন আলগা পেলেই যত গোল বাধায়।
জপধ্যান করবে, সৎসঙ্গে থাকবে, অহংকারকে কিছুতেই মাথা তুলতে দেবে না।
যখনই মনে কোন কু-ভাব আসবে, মনকে বলবে- তাঁর ছেলে হয়ে আমি কি এ কাজ করতে পারি? দেখবে- মনে বল পাবে, শান্তি পাবে।
যার উপর যেমন কর্তব্য করে যাবে, কিন্তু ভাল এক ভগবান ছাড়া আর কাউকে বেসো না।
দেখ মা, যেখান দিয়ে যাবে তার চতুর্দিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব দেখে রাখবে। আর যেখানে থাকবে সেখানকারও সব খবরগুলি জানা থাকা চাই।
কথা সত্য হলেও অপ্রিয় করে বলতে নেই। শেষে ঐরূপ স্বভাব হয়ে যায়। মানুষের চক্ষুলজ্জা ভেঙ্গে গেলে আর মুখে কিছু আটকায় না।
তাঁতে খুব বিশ্বাস রাখবে। সংসারে যেমন মা-বাপ ছেলেদের আশ্রয়স্থল, তেমনি ঠাকুরকে জ্ঞান করবে।
সন্তোষের সমান ধন নেই, আর সহ্যের সমান গুণ নেই।
ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে কজনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে কজনে?
প্রার্থনা
ঠাকুরের কাছে মনের কথা জানিয়ে প্রার্থনা করবে। প্রাণের ব্যথা কেঁদে কেঁদে বলবে –দেখবে তিনি একেবারে কোলে বসিয়ে দেবেন।
তাঁর কাছে কেঁদে কেঁদে মনের দুঃখ জানাবে, ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে বলো – ঠাকুর আমায় তোমার দিকে নাও, আমায় শান্তি দাও। এ রকম করতে করতে তোমার প্রাণে শান্তি আপনি আসবে।
মানুষের আর কতটুকু বুদ্ধি? কি চাইতে কি চাইবে! শেষে কি শিব গড়তে বানর হয়ে যাবে! তাঁর শরণাগত হয়ে থাকা ভাল।
যখন মনে কোন বিষয় উদিত হবে, জানবার ইচ্ছা হবে, তখন একাকী কেঁদে কেঁদে তাঁর নিকট প্রার্থনা করবে। তিনি সমস্ত মনের ময়লা ও কষ্ট দূর করে দেবেন, আর বুঝিয়ে দেবেন।
নির্বাসনা প্রার্থনা করতে হয়। কেন না বাসনাই সকল দুঃখের মূল, বারবার জন্ম-মৃত্যুর কারণ, আর মুক্তিপথের অন্তরায়।
হে জীব, শরণাগত হও, কেবল শরণাগত হও। তবেই তিনি দয়া করে পথ ছেড়ে দেবেন।